শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অবতরণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সংকীর্তন আন্দোলন প্রবর্তন করা। তাঁর অবতরণের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো ভক্ত তাঁকে ভালোবেসে যে আনন্দ পায় তা অনুভব করা। এই অনুভূতি লাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে নিজেই ভক্তরূপে অবতীর্ণ হওয়া। তাই যখন তিনি ভক্তভাব নিয়ে আবির্ভূত হন, তিনি কাউকে বুঝতে দিতে চাইতেন না যে, তিনি স্বয়ং ভগবান; বরং তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একজন বিনীত সেবকরূপে অভিনয় করতেন।
প্রেমবিবর্ত নামক গ্রন্থে জগদানন্দ পণ্ডিত বর্ণনা করেছেন, শৈশবে তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে পাঠশালায় যেতেন এবং তাঁরা অলকানন্দা গঙ্গার পাশে
ছোটাছুটি করতেন। তখনকার দিনে মায়াপুরের পাশ দিয়ে অলকানন্দা নদী প্রবহমান ছিল। এখন এটি প্রায় শুকিয়ে গেছে। এখনো সেখানকার বিভিন্ন জায়গায় জল দেখা যায়। এই অলকানন্দা একসময় খুবই স্রোতস্বিনী রূপে হরিহর ক্ষেত্রের নিকটে প্রবহমান ছিল। হরিহর ক্ষেত্রে ভগবান বিষ্ণু ও শিবের একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরের বিগ্রহ খুবই অদ্ভুত- বিগ্রহের অর্ধেক বিষ্ণু ও বাকি অর্ধেক শিব। ভগবান বিষ্ণ তাঁর এই বিগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন শিবকে দেখানোর জন্য যে, শিব ও তিনি অভিন্ন।
একদিন শ্রীচৈতন্যদেব ও জগদানন্দ পণ্ডিত পাঠশালা থেকে ফেরার পথে একটি শুকপাখি দেখতে পেলেন। ভগবান বললেন, “আহা, এই শুকপাখি আর শুকদেব গোস্বামী অভিন্ন। শুকদেব শ্রীমদ্ভাগবতম্ সম্পূর্ণ বর্ণনা করেছেন।” তিনি শুকপাখিকে বললেন, “কৃপা করে আমাদের রাধাকৃষ্ণের মহিমা বলো।” কিন্তু শুকপাখি রাধাকৃষ্ণের মহিমা বর্ণনা না করে গৌর গৌর! গৌর গৌর! বলতে লাগল। শ্রীচৈতন্যদেব কানে আঙ্গুল দিলেন, “না, না আমি তোমাকে রাধাকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করতে বলেছি। তুমি এসব কী বলছ? কৃপা কওে রাধাকৃষ্ণের স্তব কর।” কিন্তু সেই শুকপাখি আবার কীর্তন করতে লাগল, ‘গৌর, গৌর, গৌর, গৌর!” শ্রীচৈতন্যদেব বললেন, ‘তুমি এ কি বলছ? এই স্থান অভিন্ন বৃন্দাবন, তাই তোমার উচিত এখানে রাধাকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করা।”
এই শুকপাখি কোনো সাধারণ পাখি ছিল না, সে ছিল চিন্ময়। সে বলল, “দেখুন, রাধা এবং কৃষ্ণ একত্রে মিলিত হয়ে এখানে গৌরাঙ্গরূপে বিরাজ করছেন, তাই আমি রাধাকৃষ্ণের নাম গৌররূপে কীর্তন করতে চাই। আপনি যদি অন্য কোনো নামকীর্তন করতে চান তবে করতে পারেন। কিন্তু আমি গৌর নাম কীর্তন করব। কেননা আমার কাছে গৌরই রাধা-কৃষ্ণ।” এই বলে সে কীর্তন চালিয়ে যেতে লাগল, “গৌর, গৌর, গৌর,গৌর!”
এই শুকপাখি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রকৃত স্বরূপ জানত। “শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, রাধাকৃষ্ণ নহে অন্য! শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু।” তাই শ্রীচৈতন্যদেব এতো কৃপাময়। তিনি যে শুধু এই জড় জগতে অন্তরঙ্গ লীলা উপভোগ করতে এসেছেন তা নয়, তিনি আমাদের কৃপাদান করার জন্য, কৃষ্ণভাবনার অমৃত বিতরণের জন্য এসেছেন।
No comments:
Post a Comment