শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুসারীদের কয়েকজন বয়সে তাঁর চেয়ে বড় ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই শ্রীচৈতন্যদেব অধ্যাপনা শুরু করেন। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ছিলেন তিনি। মাত্র এগার বছর বয়সেই পি.এইচ.ডিগ্রিধারীর সম পর্যায়ভুক্ত হন এবং তাঁর নিজের পাঠশালার অধ্যাপক হন। এই অল্প বয়সেই তিনি ভারতের সেরা শিক্ষকদের একজনরূপে পরিগণিত হন।
মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই তিনি নিমাই পণ্ডিত নামে সবার কাছে পরিচিত হন।
তাঁর হাজার হাজার ছাত্র ছিল। তিনি গঙ্গাতীরে উপবেশন করতেন আর সবাই তাঁকে ঘিরে বসত। তিনি তাঁর ছাত্রদের সংস্কৃত ব্যাকরণ, কাব্য, ন্যায়শাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতি শিক্ষা দিতেন। সাধনার বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তাঁর সব ছাত্রকেই গায়ত্রী মন্ত্র জপ ও তিলক ধারণ করতে হতো। আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য গায়ত্রী মন্ত্র বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই মন্ত্র আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে একাগ্রভাবে ভগবানের ধ্যান করতে সহযোগীতা করে। আমাদেরও
গায়ত্রী মন্ত্র রয়েছে। প্রভুপাদ বলেছেন যে, আমাদের জন্য গায়ত্রী মন্ত্র অত্যাবশ্যকীয় নয়- আমরা শুধু, “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে- মন্ত্র জপ করার মাধ্যমে ভগবদ্বামে ফিরে
যেতে পারি। কিন্তু গায়ত্রী মন্ত্র আমাদের পারমার্থিক উন্নতির জন্য খুব দরকারী। গায়ত্রী মন্ত্র কৃষ্ণ থেকে অভিন্ন। কাম-গায়ত্রী কৃষ্ণের বংশীধ্বনি থেকে অভিন্ন। পাঞ্চরাত্রিক মন্ত্রগুলো আমাদের পারমার্থিক উন্নতিতে সাহায্য করে। ব্রাহ্মণ সংস্কৃতিতে প্রথমে উপনয়ন দেওয়া হয়। আমরা যে গায়ত্রী মন্ত্র পাই তার প্রথমটিই পাই উপনয়নে। সাধারণত যেসব শিশু বেদ অধ্যয়ন শুরু করে তাদের এই মন্ত্র দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের পারমার্থিক জীবনে আরো পরিপক্বতা এলে অন্যান্য পাঞ্চরাত্রিক মন্ত্রগুলো তারা লাভ করে।
মহাপ্রভু তাঁর সকল ছাত্রকে তিলক করে আসার ব্যাপারে জোর দিতেন। যদি কেউ তিলক না করে আসত, তাহলে তাকে মহাপ্রভু সবার সামনে দাঁড় করিয়ে তিরস্কার করতেন। তিনি বলতেন, “তুমি তিলক করনি কেন? তিলক ছাড়া তোমার কপার শ্মশান সদৃশ। এর মানে হচ্ছে তুমি প্রাতঃস্নান করনি, গায়ত্রী মন্ত্রও জপ করনি। তুমি যদি সবকিছু সঠিকভাবে করতে তাহলে অবশ্যই তোমার কপালে তিলক থাকত। এটি প্রাতঃকৃত্যের একটি অংশ।” এই বলে মহাপ্রভু তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন।
তখন সেই ছাত্র বাড়ি গিয়ে স্নান করে তিলক ধারণ করে, গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে তবেই পাঠশালায় ফিরে আসত। এ ধরনের বিব্রতকর অবস্থার কারণে ছাত্ররা তিলক করে ও জপ করে পাঠশালায় আসার ব্যাপারে সচেতন থাকত। দু-একজন ছাত্রকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ফলে প্রত্যেকেই তিলক করে আসতে শুরু করল। এভাবে শ্রীচৈতন্যদেব এই বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করতেন।
বেদ অধ্যয়ন করতে চাইলে গায়ত্রী মন্ত্র জপের মাধ্যমে মনকে শুদ্ধ করে তুলতে হবে। গায়ত্রী মন্ত্র মনকে বিশুদ্ধ করে, ফলে আমরা আরো শুদ্ধভাবে কৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারি। সঠিকভাবে গায়ত্রী জপ করার জন্য প্রথমে “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” এই মহানাম জপ করে শুদ্ধ হতে হবে। তাহলে গায়ত্রী মন্ত্র জপ ফলপ্রসু হবে এবং কৃষ্ণভাবনার পথে আমাদের উন্নতি হবে।
তিলক ধারণ করার মাধ্যমে আমাদের শরীরকে মন্দিরে পরিণত করে কৃষ্ণকে স্থান দেওয়া হয়। বেদে এটি দ্বাদশ- ঊর্ধ্বপুন্ড্ররূপে উল্লেখিত হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের তিলক রয়েছে, কিন্তু যখন শরীরে তিলক অঙ্কন করা হয়, তখন তাকে বলা হয় ঊর্ধ্ব। আর দ্বাদশ মানে বারো। আমাদের শরীরের বারোটি অংশে বারোটি ভিন্ন মন্ত্রের দ্বারা আমরা তিলক স্থাপন করি। নবীন ভক্তদের, বিশেষ করে যারা আশ্রিত এবং দীক্ষিত আছেন, তাদের অবশ্যই তিলক ধারণ করা উচিত। যদি কোনো কাজে বাইরে যাওয়ার জন্য গোপীচন্দন তিলক ধারণ করতে না পারা যায়, তাহলে জল তিলক করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে। এই মন্ত্র দ্বারা কৃষ্ণ কর্তৃক সুরক্ষিত হওয়া যায়।
পদ্ম পুরাণে গোপীচন্দন তিলক সম্পর্কে একটি পুরো অধ্যায় রয়েছে। চিন্ময় জগত এবং অনেক স্বর্গীয় লোকে প্রত্যেকে তিলক ধারণ করেন। এটি বৈষ্ণবতার পরিচায়ক। যখন কেউ তিলক দর্শন করে, তখন সেই তিলক তাকে চিন্ময় জগতের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই এর প্রভাব অত্যন্ত শুভ।
No comments:
Post a Comment