শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের শুভ দিনটি ছিল ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন এবং একই সাথে চন্দ্রগ্রহণের দিন। বৈদিক বিধান হচ্ছে, গ্রহণকালে সবকিছু কলুষিত হয়ে যায়, তাই কলুষমুক্ত হওয়ার জন্য এদিন পবিত্র নদীতে গিয়ে দিব্যনাম কীর্তনযোগে স্নান করতে হয়। তাই প্রায় সমস্ত নবদ্বীপের হাজার হাজার মানুষ গঙ্গায় গিয়ে কীর্তন করতে থাকে, “গোবিন্দ! গোবিন্দ! হরেকৃষ্ণ! হরিবোল!”
মুসিলমরা এসব দেখে বলতে থাকে, “এই হিন্দুরা এসব কী করছে? তারা বলছে
হরিবোল! হরিবোল! হরেকৃষ্ণ!” তাই যদিও মুসলমানদের বিশ্বাস ছিল না, তারাও ভগবানের দিব্যনাম করতে লাগল। তারা হিন্দুদের ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ বা ঠাট্টা করছিল, কিন্তু যেভাবেই হোক তারাও কীর্তন করছিল। সেই শব্দতরঙ্গে বাতাস মুখরিত হলো।
শ্রীবাস ঠাকুর ভাবতে লাগলেন, “অনেকেই বলে এই গ্রহণ অশুভ, কিন্তু দেখ প্রত্যেকেই কিভাবে দিব্যনাম কীর্তন করছে। এতো খুবই শুভ সময়। প্রত্যেকেই কীর্তন করছে হরিবোল! হরিবোল!”
এভাবে গঙ্গা থেকে আসা শ্রীকৃষ্ণের দিব্য নামোচ্চারণে মুখরিত হয়ে উঠল, তাই শ্রীবাস ঠাকুরসহ অন্য ভক্তরা খুব আনন্দিত হলেন। সাধারণত লোকজন উচ্চৈঃস্বরে কৃষ্ণনাম করত না। স্মার্ত ব্রাহ্মণরা বলতেন যে, উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম করা অপরাধ- নাম তার শক্তি হারাবে। যেহেতু লোকজন অশুদ্ধ, তাই তাদের উচ্চৈঃস্বরে কীর্তন করা উচিত নয়।” কিন্তু যখন তারা গঙ্গায় ছিল, তখন তা অনুমোদিত ছিল; কারণ গঙ্গা পবিত্র, তাই সবাই তখন কীর্তন করছিল।
বৈষ্ণবেরা খুব খুশি হয়েছিলেন। তারা ভাবছিলেন, “এই দিনকে কেন অশুভ দিন বলা হচ্ছে, এই দিনটি বছরের শ্রেষ্ঠ দিন- প্রত্যেকেই পবিত্র নদীতে স্নান করছে, নৃত্য করছে, ভগবানের নামকীর্তন করছে।” তারা সকলকে হরিনাম করতে দেখে উল্লসিত হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন।
তাই, সে সময় শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর কৃপা বর্ষণ করার জন্য আবির্ভূত হলেন। যখন তিনি আবির্ভূত হলেন, তখন চন্দ্র উদিত হচ্ছিল এবং সমগ্র ভারত হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে
এই অপ্রাকৃত শব্দতরঙ্গে মুখরিত ছিল।
সর্বত্রই এই সংবাদ প্রচারিত হলো যে, শচীমাতা একটি ফুটফুটে ছেলের জন্ম দিয়েছেন, যাঁর গায়ের বর্ণ স্বর্ণের মতো। তাই সকল প্রতিবেশী মহিলা সেই ছেলেকে দেখতে এলেন এবং ব্রাহ্মণ মহিলারা তাঁর কপালে দূর্বা ও হরিদ্রা মিশ্রিত চাল দিয়ে আশীর্বাদ করতে লাগলেন। এটি ছিল অত্যন্ত আনন্দঘন ও উৎসবমুখর মুহূর্ত।
এমনকি উচ্চতর গ্রহলোক থেকেও কেউ কেউ ভগবানকে দর্শন করার জন্য নেমে আসতে লাগলেন, দেবদেবীরা ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণীর বেশ ধারণ করেছিলেন। শচীমাতা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, “এত লোক কোথা থেকে আসছে?”
জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ। কিন্তু তিনি মনে মনে অনেক গাভি দান করলেন এবং দরিদ্রের ভোজন করালেন। এমন একটি সুন্দর পুত্রসন্তান লাভ করে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন।
অদ্বৈত গোসাই অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে শান্তিপুরে নৃত্য করতে লাগলেন, ফুলিয়াতে হরিদাস ঠাকুর সমাধিস্থ হয়ে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করতে লাগলেন। এভাবে সকল বৈষ্ণব তাঁদেও হৃদয়ে অপ্রাকৃত আনন্দ অনুভব করতে লাগলেন। কারণ, পরমেশ্বর ভগবান আবির্ভূত হয়েছেন।
পরদিন অদ্বৈত আচার্যের স্ত্রী সীতা ঠাকুরানী শ্রীচৈতন্যদেবকে দর্শন করতে এলেন। তিনি অত্যন্ত অভিজাত ছিলেন। যেহেতু অদ্বৈত ছিলেন সকল ব্রাহ্মণের মধ্যে অগ্রগণ্য, তাই সীতা ঠাকুরানী শ্রীচৈতন্যদেবের জন্য বিশেষ উপহার সামগ্রী নিয়ে এলেন। সুগন্ধি তৈল, শস্যদানা এবং শিশুর নিরাপত্তার জন্য একটি বাঘের নখ দিলেন। শিশুরূপে ভগবানকে অবতীর্ণ হতে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন।
No comments:
Post a Comment