একদিন এক
ব্রাহ্মণ ভিক্ষুক জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে এলেন। তিনি গোপাল বিগ্রহের পূজা
করতেন। তিনি এসে জগন্নাথ মিশ্রের সঙ্গে কৃষ্ণকথা আলোচনা করছিলেন। জগন্নাথ
মিশ্র ও শচীমাতা খুবই অতিথিপরায়ণ ছিলেন। বিশেষত কোনো বৈষ্ণব অতিথি তাঁদের
গৃহে প্রসাদ গ্রহণ করলে তাঁরা অত্যন্ত আনন্দিত হতেন। তাই একজন বৈষ্ণব
ভক্তকে গোপাল বিগ্রহসহ ভ্রমণ করতে দেখেই তাঁরা তাঁকে অনুরোধ করলেন,
“কৃপাপূর্বক কিছু প্রাসাদ গ্রহণ করুন।” ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব
উত্তর দিলেন, “আমি
আমার গোপালকে ভোগ না দিয়ে কিছুই গ্রহণ করি না। তাই যতক্ষণ না গোপালের ভোগ
হবে, ততক্ষণ আমি কিছুই খাব না। তবে আপনাদের ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আপনারা
শুধু আমাকে কিছু ফলমূল দিন। আমি তা আমার গোপালকে নিবেদন করব।” কিন্তু তাঁরা
বললেন, “আপনি সব সময় জঙ্গলেন ফলমূল গ্রহণ করে থাকেন, একবার আমাদেরকে কিছু
ভালো আহার্য দেবার সুযোগ দিন। আপনি আমাদের অতিথি, আমরা কীভাবে আপনাকে শুধু
ফল খেতে দিতে পারি? আমাদেরকে একটি রাজভোগ তৈরির সুযোগ দিন। আমরা
ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী। তাই আমরা রান্না করে দিচ্ছি আর আপনি তা নিবেদন করুন।
ব্রাহ্মণ
অতিথি তাঁদের প্রস্তাবে সম্মত হলেন। শচীমাতা অন্য গৃহিণীদের নিয়ে অতি
আনন্দের সাথে সবজি তৈরি করে খুব সুন্দর রাজভোগের আয়োজন করলেন। ব্রাহ্মণ
একটি থালায় সেই নৈবেদ্য সাজিয়ে গোপালের সামনে নিয়ে গেলেন।
শ্রীবিগ্রহ
সেবার একটি অংশ হচ্ছে ধ্যানের মাধ্যমে ভগবানকে আহ্বান করা, যেন তিনি এসে
নৈবেদ্য গ্রহণ করেন। তাই সেই ব্রাহ্মণ ধ্যানে বসলেন এবং ভগবানকে আহ্বান
করলেন, “গোপাল! গোপাল! এসো, এই ভোগ গ্রহণ করো। গোপাল! তুমি এখানে এসে এই
নৈবেদ্য গ্রহণ করো।”
যখন তিনি এভাবে ধ্যান করছিলেন, তখন ছোট্ট নিমাই
সেখানে এসে গোপালের ভোগ খেতে আরম্ভ করল। সবাই দেখল, নিমাই থালা থেকে ভোগ
খেতে শুরু করেছে। তাই, তারা বলে উঠল, “হায়, হায়, কী সর্বনাশ!” ব্রাহ্মণ চোখ
খুলে থালার দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে, একটি বাচ্চা ছেলে নৈবেদ্য খাচ্ছে। এসব
দেখে তিনিও চিৎকার করে উঠলেন, “হায়! হায়! এতো নষ্ট হয়ে গেছে!” তিনি জানতেন
না যে, গোপাল স্বয়ং তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এসে এই নৈবেদ্য গ্রহণ করছেন। তিনি
ভেবেছিলেন, সে নৈবেদ্য নষ্ট করে দিয়েছে।
তখন জগন্নাথ মিশ্র সবকিছু
জানতে পেরে এতই রেগে গেলেন যে, তিনি নিমাইকে শাস্তি দেওয়ার জন্য হাতে লাঠি
নিলেন আর নিমাই ঘরের ভিতর এদিক-ওদিক দৌঁড়াতে লাগলেন। জগন্নাথ মিশ্র একটা
ছোট লাঠি নিয়ে বললেন, “দুষ্টু ছেলে এ কি করেছ তুমি? ব্রাহ্মণের ভোগ নষ্ট
করে দিচ্ছ?”
ব্রাহ্মণ ভয় পেলেন। তিনি জগন্নাথ মিশ্রকে নিরস্ত করে বললেন,
“দয়া করে ওকে মারবেন না। সে নিষ্পাপ। কিছু বুঝে না। এই ছোট্ট শিশু কী-ই বা
জানে? ঠিক আছে, আমার ভাগ্যে বুঝি আজ ভোজন নেই। আমাকে শুধু কিছুু ফল দিন।”
তখন
মিশ্র পরিবারের হয়ে সবাই বলতে লাগলেন, “না..না.. প্রভু,আমরা গৃহস্থরা এক
সঙ্গে থাকি। আমাদের অতিথি যদি খেতে না পারে, তবে আমরা কিভাবে বাঁচব? আমরা
সবাই খুব কষ্ট পাব, আপনি কৃপা করে আমাদের আরেকবার রান্নার সুযোগ দিন। আমরা
আরেকটি ভোগ তৈরি করছি, আপনি সেটি নিবেদন করুন।” সকলের অনুরোধে ব্রাহ্মণ
শেষবারের মতো রাজি হলেন।
এবার তাঁরা নিমাইকে অনত্র রেখে এলেন। ব্রাহ্মণ
তাঁদের প্রস্তাবে আবারো রাজি হওয়ায় গৃহিণীরা সবাই খুব খুশি হলেন এবং প্রবল
উৎসাহ নিয়ে আবার রান্না করতে লাগলেন। সন্ধ্যা ছ’টার দিকে ভোগ প্রস্তুত হলো।
ব্রাহ্মণ আবারো ধ্যানে বসে ডাকতে লাগলেন, “গোপাল এসো, এই নৈবেদ্য গ্রহণ
করো।” তখন কোথা থেকে যেন নিমাই এসে আবার নৈবেদ্য খেতে আরম্ভ করল। ব্রাহ্মণ
তা দেখে চিৎকার দিলেন। এবার জগন্নাথ মিশ্র সত্যিই অত্যন্ত রেগে গেলেন। তিনি
নিমাইকে ধমক দিয়ে বললেন, “এবার সত্যিই তোমার কপালে দূর্ভোগ আছে নিমাই।
তুমি ব্রাহ্মনের নৈবেদ্য নষ্ট করলে কেন?
নিমাই ভয়ে পিতার কাছ থেকে দৌড়ে
পালাল। ব্রাহ্মণ আবার জগন্নাথ মিশ্রকে শান্ত করার জন্য বললেন, “দয়া করে
ক্রুদ্ধ হবেন না। সবই ভগবানের ইচ্ছা, আজ আমার ভাগ্যে হয়ত ভোজন নেই।”
তখন
নিমাইয়ের বড় ভাই বিশ্বরূপ, অদ্বৈত গোসাইয়ের ভাগবত পাঠ থেকে ফিরলেন। সে সময়
বিশ্বরূপের বয়স নয়-দশ বছর হবে। ব্রাহ্মণ বিশ্বরূপকে দেখে অভিভূত হয়ে
গেলেন, কেননা তিনি ছিলেন একজন ভক্ত আর বিশ্বরূপ স্বয়ং সংকর্ষণ। বিশ্বরূপের
প্রতি তিনি খুবই আকৃষ্ট হলেন। তিনি বললেন “ এই বালকটি কে?” তাঁর চিত্ত
তৎক্ষণাৎ বিশ্বরূপের প্রাতি ধাবিত হলো, “এই বালকের সৌভাগ্যবান পিতামাতা
কারা?” তিনি সম্পূর্ণরূপে বিমোহিত হলেন।
No comments:
Post a Comment